কৃষ্ণপক্ষ শুক্লপক্ষ/একটি মাসের দুটি পক্ষ/আমার উনি প্রথম পক্ষ খুশির সীমা নাই/ কখন বধূর দেখা পাই/ মনটা……… জামাইষষ্ঠী বা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা ভাবলেই এই চলচ্চিত্র চঞ্চরী। মাঠের আলপথ ধরে দীপঙ্কর দে গাইতে গাইতে এবং প্রায় নাচতে নাচতে চলেছেন। আজ রণর সেই দিন। বিয়ের পর প্রথম বছর। অবশ্য জোড়ে। বিয়েতে পাওয়া গোটা পাঁচ বেনারসির এক নীলাম্বরী পরনে শালিনী। খাসা লাগছে কিন্তু। বেশ পরস্ত্রী পরস্ত্রী মনে হচ্ছে। ওর কানে গেলে দু চারটে কিল কপালে। রণ অবশ্য রীতিমত সুপুরুষ। জামদানী কাজের পাঞ্জাবী আর লাল টুকটুক ট্রাউজার ধুতি। বাইরের গরমের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ইনোভার ভিতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। খুনসুটি চলুক। আমরা একটু দেখি জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব তালাশ।
প্রাচীন বঙ্গীয় সমাজ। পুরুষতান্ত্রিক। বিয়ের পর পুত্রসন্তানের জন্ম না দেওয়া পর্যন্ত মেয়ের বাবা মা মেয়ের বাড়ি যেতে পারেন না। কিন্তু কজন শুভবুদ্ধির মানুষজন তো আছেন সমাজে। কালো বেড়াল আর মা ষষ্ঠীর গল্প ফেঁদে তাঁরা বললেন, কন্যার পিতৃগৃহে মেয়ে জামাইকে জোড়ে বরণ এবং পূজা ও ব্রত উদযাপন না করলে ভাবী সন্তানের অমঙ্গল। সুতরাং কোনও এক মেয়ের মনকেমনের অশ্রুধারা মোছাতে জামাইয়ের শুভাগমন। জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে এই আয়োজন।
নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরের সেবায়েতরা এই দিন জামাই পূজা করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া ওঁদের বংশের মেয়ে। তাই নিমাই এর পূজা হয় মহাসমারোহে। এই জামাইষষ্ঠীর হাজার কাহিনি।
অনেকে একে বলে অরণ্যষষ্ঠী। এতেও সেই কালো বেড়াল আর ছোটো বউয়ের কাহিনি। হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনো খানে। আগের দিন রাতে একটা ঘটে পূণ্যজল ভরে ঈশান কোণে পুঁতে রাখতে হয়। একটা গাছের ডাল, সপ্তপত্রের তালপাখা, বাঁশের নতুন বের হওয়া শীষ, ষাট গাছি দূর্বা, সমসংখ্য ধান আর বৃন্তসমেত জোড়া করমচা। বিধিসম্মত সাজিয়ে ঘটের জলের ছিটা দিয়ে বরণ। মেয়ে জামাইকে। হলুদে ছোপানো সুতা হাতে বেঁধে দেওয়া হয় মঙ্গলকামনায়। পরিধেয় হলুদ জামা কাপড় প্রদানের রীতি। হাতে দেওয়া হয় অপরাজিতা ফুল। তবে কে আর সব মানে। কে-ই বা সব জানে! লোকে যা করে, তাই লোকাচার। ষষ্ঠী উপাসনার ডালির নাম— বাঙাল বাড়িতে মুইঠ্যা আর ঘটিবাড়িতে বাটা। তবে বরিশালের মেয়েকে বউ করে আনলে জামাইষষ্ঠী ভুলে যাওয়াই ভালো। ওখানের মানুষের এই চল নেই।
নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরের সেবায়েতরা এই দিন জামাই পূজা করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া ওঁদের বংশের মেয়ে। তাই নিমাই এর পূজা হয় মহাসমারোহে। এই জামাইষষ্ঠীর হাজার কাহিনি। জামাইকে ঠকাতে গিয়েই নাকি সূর্য মোদকের বিখ্যাত জলভরা সন্দেশের জন্ম। কামড় দিতেই রস গড়িয়ে পড়ে শখের পাঞ্জাবী বরবাদ।
তা রণর শ্বশুরমশাই নবদা আমাকে একটা স্পেশাল রেসিপি চাইলেন জামাই আদর করতে।
(হৃদয়ের… একটু নিচে রাজপুতানার খাজানা :লাল মাস )
অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম এই একটা পদে আমি প্রত্যেকবারই মোটামুটি উৎরে গেছি….. লাল মাস l সুতরাং আজকের আইটেম…. লাল মাস l
অনেক অনেক দিন আগের কথা l রাজস্থান l রাজা, উজির, পাত্র, মিত্র, সৈন্য সামন্ত নিয়ে শিকারে চললেন l সঙ্গে খানসামা l হরিণ,বন্য শুয়োর শিকার হলl কিন্তু রান্নার তাঁবু আর রাজামশায়ের তাঁবু তো লাগোয়াl মাংসের আঁশটে গন্ধ ছড়ালেই গর্দানl সুতরাং ঘি, সুতরাং শুকনো লংকায় নুন দিয়ে মাংসকে জারিয়ে নেওয়াl তারপর শুল্যপক্ক অর্থাৎ কিনা আগুনে সেঁকাl জলের অভাব তো l গরগরে ঝাল টকটকে লাল সেই আদি অকৃত্রিম লাল মাস যা আদতে শিকারী মাস (মাংস)l কত জিনিস আর শিকারে বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব! ঘি আর শুকনো লঙ্কা…. ব্যসl ঘি ছাড়া আসলে রাজস্থানি খাবার অস্তিত্ববিহীন l গোটা রাজস্থানে ছড়িয়ে খামাগানী আর ঘিয়ের আন্তরিকতা l
দিন যায় l শিকারের জঙ্গল ছাড়িয়ে লাল মাস রাজপ্রাসাদে l নিঃশ্বব্দ বিপ্লব ক্রমশ রান্নাতেও l লা জবাব খানসামাদের হাতে l যোধপুরের কাছে এক গ্রাম মাথানিয়া l বড়বড় লাল লঙ্কা……. ঝাল অসহ্য নয় l মাথানিয়া মির্চ আর লাল মাস অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে পড়ল l কিছু বছর আগে লাল মাসের এক প্রতিযোগিতা হয়েছিল… লাল মাস তুমি কার? শুনেছি মুকুট মেবারের মাথাতেই উঠেছিলl
দিন বদলায় l রাজপ্রাসাদ ছেড়ে লাল মাস আমজনতার হেঁসেলে l কিন্তু অধিকাংশ রাজপূত পরিবারের রান্নাঘর তো আমিষবর্জিত l পুরুষরা সান্ধ্য আড্ডার সাথে ঢিমে আঁচে লাল মাস তৈরি শুরু করল l লাল মাসের ইতিহাস পুরোটাই পুরুষকেন্দ্রিক l হরিণ বা বরাহের অভাবে এল ভেড়া- ছাগল l এলো দই, রসুন, সর্ষে তেলের সঙ্গত l তবে মির্চ তো মাথানিয়া হতেই হবে l বর্ষা কি গরম, শীত বা বসন্ত, ঢিমে আগুনের চারপাশে বসে মাখা মাখা লাল মাস আর হাতে গরম চাপাতির যুগলবন্দি যেন পন্ডিত যশরাজ আর মারওয়া l কোমল রে আর শুদ্ধ ধৈবতের ঢাল বর্শার খেলা l ঢাল সরে যায় আর বর্শা সটান বেঁধে হৃদয়ের এপার ওপার l হায় হায় মার্ ডালা l
আমার লাল মাসের গুরু রণবীর ব্রার l মন ভালো করে দেওয়া রেওয়াজি খাসির গর্দান আর কাঁধের কম চর্বিওয়ালা মাংস…. অবশ্যই হাড় সমেত, গাওয়া ঘি, আদা বাটা, তার দ্বিগুন পরিমাণ রসুনবাটা, চার ছয় কোয়া গোটা রসুন, প্রতি কেজি মাংসের জন্যে ১৫/১৬ টা মাথানিয়া শুকনো লঙ্কা, নুন, সামান্য চিনি, ছোট এলাচ, বড় এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, তেজপাতা, গোটা কয়েক কালো মরিচ, একটু দই, এক চিমটে ধনেগুঁড়ো, সর্ষে তেল, সামান্য লঙ্কাগুঁড়ো l আর এক প্লেট ডালমুট l
মাংসে আদা রসুনবাটা মাখিয়ে ঢাকা দিয়ে এককোণে l যত বেশি মজবে, খেতে তত মজা l লঙ্কাগুলো ভিজিয়ে রাখুন ঘন্টাখানেক l লঙ্কা আর রসুনের কোয়াগুলো বেটে নিন একসঙ্গে l এবার রান্না শুরু l গরম কড়ায় ঘি l গোটা গরম মসলা আর তেজপাতা l একটু পরে পেঁয়াজকুঁচো…. ওহ…….আগে বলতে ভুলে গিয়েছি l নাড়তে থাকুন প্রেম করার মত…. I পেঁয়াজ নরম হয়ে এলো কি? মাংসটা নেওয়ার জন্যে ও তৈরি l খুন্তি চালু থাক l ঘিতে মাংস ভাজার সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে এপাশ ওপাশl মাংসের রং একটু ফ্যাকাশে হয়ে উঠলে লঙ্কাবাটা মিশিয়ে দিন l আঁচ কমাবেন না মোটেও l এবার খেলা শুরু l এতক্ষণ তো চলছিল গা গরম করার পালা l সেবাদাসের মত খুন্তি নাড়তে থাকুন… মিশে যাচ্ছে মাংসের প্রতিটি টুকরোর সঙ্গে টুকটুকে লাল লঙ্কাবাটা l আসলে লংকায় ঝালের মধ্যে লুকিয়ে থাকে মিষ্টি l সেই লুকিয়ে থাকা মিষ্টিকে খুঁজে বের করে আনাতেই লাল মাস রান্নার সিদ্ধিলাভ l
কষতে কষতে একসময় গুড় তৈরির মতো একটা মিষ্টি গন্ধে চারদিক ম ম l কষা সমাপ্ত l পরিমাণ মত নুন, একটু জল l মিনিট পাঁচেক নাড়াচাড়া l প্রেসার কুকারে দুটো সিটি….. দশ বারো মিনিট কম আঁচ l এবার জাদু l একটা বাটিতে দই, চিনি, লঙ্কাগুঁড়ো, ধনেগুঁড়ো আর সর্ষেতেল ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে মিলিয়ে দিন মাংসের সঙ্গে l দই আর সর্ষে তেল রান্নাটাকে পরিণত করে তুলবে l গ্রেগরি পেক বা ক্লিন্ট ইস্টউডের মত অপ্রতিরোধ্য l আজ খাবেন না প্লিজ l কাল খাবেন l তারপর মাঝে মধ্যেই খেতে ইচ্ছে করবে l তবে অবশ্যই মাথানিয়া মির্চ l নাহলে আপনার চোখ মুখ কান ইত্যাদি লাল হয়ে যাবে….. কিন্তু লাল মাস ঠিক তেমনটা লাল হবে না l
ও হো…..ভালো কথা….. ডালমুটটা মাংস কষার সময় একটু একটু করে খেয়ে নেবেন l অনেক সময় লাগে কিনা……. কষতে….. l
শেষ পাতে একটু মিষ্টিমুখ। মিষ্টি আম। হিমসাগর হলে ভালো হয়। গাছপাকা। খোসা ছাড়িয়ে ছোট টুকরো করে নিন। দুধের এক লিটারের টেট্রাপ্যাক ফুটিয়ে অর্ধেক। ওর সঙ্গে তিন চামচ ফ্রেশ ক্রিম। কিছুটা দুধ ঠাণ্ডা করে ম্যাংগো ফ্লেভার কাস্টার্ড পাউডার দেড় টেবিল চামচ। ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। বাকি দুধে দু চামচ (বড়) চিনি। একটু ফুটুক কম আঁচে। এরপর কাস্টার্ড পাউডার মেশানো দুধ দিয়ে মিনিট পাঁচ কম আঁচে মোলায়েম নাড়াচাড়া। রান্নাতে যেন ভালবাসা মিশে থাকে। মনোজ মিত্রের হাজারি ঠাকুরের মতো। খাইয়ে তৃপ্তি।
এরপর সুদৃশ্য পোর্সিলেনের বা কাচের কাস্টার্ড বাটিতে ঢেলে দেওয়া। একটু ঠাণ্ডা হলে হালকা হাতে আমের টুকরোগুলো মিলিয়ে দিয়ে রেফ্রিজারেটরের আশ্রয়ে। ঘণ্টা দুই। অনেকে বলবেন কিছু কিসমিস, পেস্তা, আমন্ড কুচি, কেশর কেন নয়? দিতেই পারেন। পসন্দ আপনা আপনা। কিন্তু আম কাস্টার্ডে আমের জমিদারিই ভালো। তাই না?
রণ খেতে বসেছে। একহাতি ঝকঝকে কাঁসার থালা। ছোটবড় বাটিরা নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে আশেপাশে। রণ বেশ নার্ভাস। এতো কিছু? লাল মাস আর আম কাস্টার্ড – শুদ্ধ ধৈবত আর কোমল রে –এর অনবদ্য সংগতে। আমিও চললাম। আমার স্বশুরবাড়িতেও তো অপেক্ষায। বিয়েতে শাশুড়ির একমাত্র শর্ত। মানতে তো হবেই। ভালো থাকবেন। ভালো রাঁধবেন।